মহালয়া: দ্বন্দ্বের ছায়ায় বাঙালির ভোরে জাগে জগৎমাতার আগমনবার্তা
ভাস্কর চক্রবর্তী, শিলিগুড়ি - ভোর রাতের নিস্তব্ধতা হঠাৎ ভেঙে যায় এক গম্ভীর অথচ মধুর সুরে— “জাগো দুর্গা, জাগো দশপ্রহরণধারিণী...”। চোখ মুছতে মুছতে বাঙালি বুঝে যায়—আবার এলো মহালয়া। বছরের বাকি দিনগুলোয় হয়তো রেডিওর সুইচে হাত যায় না, অথচ এই ভোরে পুরনো সেই যন্ত্রটার ধুলো ঝেড়ে পরিবারের সকলে বসে পড়ে। শ্রীবীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠস্বর যেন মন্ত্রপাঠের সঙ্গে সঙ্গে ঢেউ তোলে বাঙালির রক্তে। কত শত বছর ধরে এভাবেই মহালয়ার ভোর বাঙালির জীবনে উজ্জ্বল হয়ে আছে।
আমাদের উৎসবগুলি নির্ণীত হয় সূর্য আর চন্দ্রের গতিপথের উপর ভিত্তি করে। সূর্যের দক্ষিণায়নে দেবগণ নিদ্রামগ্ন হন, আবার উত্তরায়ণ এলে তাঁরা চোখ মুছে উঠে বসেন। আর আমরা দেখি সূর্যদেব কখনও আকাশের দক্ষিণ দিককে চারণভূমি করেন, কখনও বা উত্তরের দিকে চলেন। তাঁর এই যাত্রাপথকেই আমরা দেবতাদের ঘুমের কাল রূপে চিহ্নিত করেছি। মহালয়ার দিনটিও এই চন্দ্র সূর্যের গতিপথের খেলা। এবার আরও স্পষ্টভাবে সকলের কাছে তা প্রতীয়মান হয়েছে কারণ, পিতৃপক্ষ সূচনার দিন যে ভাদ্র পূর্ণিমা ছিল সেই পূর্ণিমার দিনে আমরা বিরল চন্দ্রগ্রহণের দেখা পেয়েছি। শেষ হবে সূর্যগ্রহণের মধ্য দিয়ে।
কিন্তু প্রতিবছর মহালয়ার আগে কিংবা পরে বিশেষত সামাজিক মাধ্যমে এক বিতর্ক নতুন করে জাগে। অনেকে লেখেন— “মহালয়া কোনো শুভ তিথি নয়, শুভ মহালয়া বলা বোকামি।” যুক্তি হিসেবে বলা হয়, এদিন নাকি পিতৃপুরুষেরা স্বর্গলোক থেকে মর্ত্যে নেমে আসেন এবং তাদের উদ্দেশ্যে তর্পণ ও শ্রাদ্ধ করা হয়। তাই একে শুভ নয়, বরং অশুভ বলেই ধরা উচিত। আবার, আরেকটি প্রশ্নও ঘোরাফেরা করে— “পিতৃপক্ষ থাকলেও মাতৃপক্ষ কেন নেই?” এসব লেখা ও আলোচনা দেখে সাধারণ মানুষ দ্বিধায় পড়েন। যাদের শাস্ত্র সম্পর্কে তেমন জানাশোনা নেই, সংস্কৃত পাঠের গভীরে যাওয়ার সময় হয় না, তারা মনে করেন— সত্যিই কি মহালয়া অশুভ? সত্যিই কি কেবল পিতাদের জন্যই এ আয়োজন, নারীদের কোনো স্থান নেই?
মহালয়ার মূল তাৎপর্য
হিন্দু শাস্ত্র মতে, মহালয়া পিতৃপক্ষের সমাপ্তি ও দেবীপক্ষের সূচনা। মহালয়ার সকালে গঙ্গার ঘাটে বা নিকটবর্তী নদীতীরে পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে তর্পণ করাই এদিনের প্রধান রীতি। তর্পণ শব্দের অর্থ হল জল ও তিল অর্ঘ্য দিয়ে পিতৃপুরুষদের আত্মার শান্তি কামনা করা। বিশ্বাস করা হয়, এই বিশেষ দিনে পিতৃপুরুষেরা মর্ত্যে নেমে আসেন পরিবারের তর্পণ গ্রহণ করতে। সেই অর্ঘ্যে তৃপ্ত হয় তাঁদের আত্মা, আর আশীর্বাদে ধন্য হয় পরিবার।
পিতৃপক্ষের প্রকৃত অর্থ
শাস্ত্রবিদদের মতে, সপ্তম শ্রেণির সংস্কৃত পাঠ থেকেই স্পষ্ট বোঝা যায়— পিতৃপক্ষের পুরো সময়কাল “পিতরৌ” অর্থাৎ পিতরহ্দের উদ্দেশ্যেই উৎসর্গিত। ‘পিতর’ শব্দ কেবল পিতা নয়, বরং পিতা, মাতা, পিতামহ-পিতামহী, প্রপিতামহ-প্রপিতামহী সহ বংশপরম্পরার সমস্ত নারী-পুরুষকেই বোঝায়। অর্থাৎ, এখানে কেবল পুরুষ নন, পরিবারের সকল পূর্বপুরুষ ও পূর্বমাতৃকাদেরও সমানভাবে সম্মান জানানো হয়। বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় যেহেতু ‘পিতৃপুরুষ’ বলতে পিতৃ-পরম্পরাকেই ধরা হয়, তাই অনেকের ধারণা হয়— কেবল পুরুষদের উদ্দেশ্যেই তর্পণ হয়। কিন্তু প্রকৃত অর্থে তা নয়। শাস্ত্রমতে, আমাদের গোটা বংশ— নারী-পুরুষ নির্বিশেষেই— “পিতর” শব্দে অন্তর্ভুক্ত।
‘শুভ মহালয়া’ বিতর্ক
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সামাজিক মাধ্যমে এক ধারণা ছড়িয়ে পড়েছে যে মহালয়া আদৌ শুভ নয়। যুক্তি হিসেবে বলা হয়, এদিন পিতৃপুরুষেরা মর্ত্যে নেমে আসেন, তাই দিনটি অশুভ। অনেকে আবার প্রশ্ন তুলেছেন, পিতৃপক্ষ থাকলেও কেন মাতৃপক্ষ নেই? নারীদের জন্য আলাদা শ্রাদ্ধ কেন নেই? এসব প্রশ্ন সাধারণ মানুষের মনে বিভ্রান্তি তৈরি করছে। কিন্তু সংস্কৃত শাস্ত্র ও প্রাচীন ব্যাখ্যা থেকে জানা যায়, পিতরৌ শব্দের অর্থ কেবল পিতা নয়, বরং পিতা-মাতা, পিতামহ-পিতামহী, প্রপিতামহ-প্রপিতামহী সহ গোটা বংশপরম্পরা। অর্থাৎ পিতৃপক্ষের শ্রাদ্ধে নারীরাও অন্তর্ভুক্ত। পিতৃপুরুষ মানেই গোটা বংশের পূর্বসূরি, কেবল পুরুষ নন। তাই মাতৃপক্ষ নেই—এই ধারণা আসলে ভ্রান্ত।
শুভ না অশুভ?
এখানে আরও একটি বিষয় জানা খুব প্রয়োজনীয় সেটি হল, এই পুরাণ অনুসারে সকলের জন্য একদিনে তর্পণ প্রশস্ত নয়। পিতৃপক্ষ পড়ার পর প্রতিটি তিথি মৃত্যুর কারণ অনুযায়ী পৃথক পৃথক জলদানের তিথি রূপে নির্ণীত হয়। যেমন এই পুরাণ অনুযায়ী যাঁরা অপঘাতে মারা যান তাঁদের এই তর্পণ পিতৃপক্ষের পঞ্চমী তিথিকে করা উচিত। সুতরাং যদি তর্পণের জন্য মহালয়াকে অশুভ তিথি বলে চিহ্নিত করা হয় তবে এই দোষে সমস্ত পিতৃপক্ষ দায়ী। কেবল মহালয়া তিথিকে অশুভ বলা যাবে না কখনওই। বরং অত্যন্ত পবিত্র ও মহাপুণ্য তিথি। শ্রাদ্ধ শব্দের অর্থই শ্রদ্ধা নিবেদন। পিতৃপুরুষদের প্রতি এই শ্রদ্ধা নিবেদন কোনোভাবেই অশুভ হতে পারে না। বরং শাস্ত্রমতে, শ্রাদ্ধকার্য দেবকার্যের থেকেও উচ্চতর। বিবাহ, অন্নপ্রাশন, উপনয়ন থেকে শুরু করে যেকোনো শুভ কাজের পূর্বে পিতৃশ্রাদ্ধের বিধান রয়েছে। কারণ, পূর্বপুরুষ না থাকলে বর্তমান প্রজন্মের অস্তিত্বই সম্ভব নয়। শাস্ত্রে বলা হয়েছে—“স্বর্গাদপি গরীয়সী”—অর্থাৎ স্বর্গের থেকেও মহান পিতা-মাতা ও পিতৃপুরুষের আশীর্বাদ। তাই মহালয়ার দিন তাঁদের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা নিবেদন করে ভক্তরা কামনা করেন পিতৃআশীর্বাদ। সেই আশীর্বাদেই সংসার হয় শান্তিময়, পৃথিবী হয় ধন্য।
অন্যদিকে, কালিকাপুরাণ অনুযায়ী শ্রাদ্ধ অত্যন্ত শুভ কাজ। যে পরিবারের সদস্যরা শ্রদ্ধার সঙ্গে পিতৃপুরুষকে জলদান করেন তাঁদের জীবনে, পরিবারে, অত্যন্ত সমৃদ্ধি আসে। অনেক পরিবারের নিয়ম আছে পরিবারের সদস্যদের কারো মৃত্যু হলে প্রথম শ্রাদ্ধের পর প্রতি মাসে শ্রাদ্ধ পালন করা হয়। পরে বারো মাস অতিক্রান্ত হলে বাতসরিক শ্রাদ্ধ সম্পন্ন করার পরই গয়ায় পিণ্ডদান করে আসেন পরিবারের কোনো সদস্য। তাছাড়াও তাঁরা প্রতি মহালয়ার দিন জলদান করেন। এটা হল অবশ্যকরণীয় কৃত্য।
যদি মহালয়ায় তর্পণের মন্ত্র ও তার ক্রমকে নিয়ে কেউ পুঙ্খানুপুঙ্খ চিন্তা করেন তবে এর গভীরতা সম্বন্ধে সম্যক ধারণা করতে সক্ষম হবেন। কারণ, এ কেবল নিজ পিতৃপুরুষকে জলদান করা নয়, এ হল নিজের মাতৃকুলকেও জলদানে তৃপ্ত করা। এখানেই তা শেষ নয়, এর ব্যঞ্জনা আরও গভীর হয়ে ওঠে যখন তর্পণকারী নাম না জানা, পরিচয় না থাকা, আত্মীয়স্বজনহীন মানুষগুলির উদ্দেশ্যে জলদান করেন। এ তো আধ্যাত্মিক সেবা! শ্রাদ্ধ বলে তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া যায় না।
কেবল তাই নয়, পিতামহ ভীষ্মকেও আমরা এই দিন জলদান করি। যিনি ভীষণ প্রতিজ্ঞা করে নিজের পরিবার গঠনে বিমুখ থেকেছেন। সুতরাং সেই ত্যাগকে এই দিনে স্মরণ করি আমরা। এই ব্যাপক অর্থগুলি আমাদের কাছে প্রকাশিত নয়, তাই আমরা তিথিকে অশুভ বা শুভেচ্ছা প্রেরণের উপযোগী দিন নয় বলে চিহ্নিত করেন। আমরা লোকায়ত ধারায় কেবল দেবীর সঙ্গে এই তিথিকে যুক্ত করে রাখি। কন্যারূপে এই দিন তিনি পিতৃগৃহে যাত্রা করলেন ভেবে আনন্দিত বাঙালি আমরা। তাই এই দিক থেকেও মহালয়া শুভ তিথি বৈকি!
মহালয়া: সত্যিকারের মহা-আলয়
ধর্মগ্রন্থ মতে, বিবাহ, অন্নপ্রাশন, গৃহপ্রবেশ, দেবতা প্রতিষ্ঠা বা যেকোনো শুভ কর্ম শুরুর আগে পিতৃশ্রাদ্ধ আবশ্যক। কারণ, পিতৃপুরুষ না থাকলে আমাদের অস্তিত্বই থাকত না। তাই তাঁদের আশীর্বাদই সর্বাগ্রে। শাস্ত্রকারেরা বলেছেন— “স্বর্গাৎ উচ্চতর পিতা” অর্থাৎ পিতার স্থান স্বর্গের থেকেও শ্রেষ্ঠ। এমনকি বিশ্বাস করা হয়, এই দিনে পূর্বপুরুষদের আশীর্বাদে গোটা পৃথিবী এক মহা-আলয় বা “মহালয়” হয়ে ওঠে। তাই এই দিনকে অশুভ বলা শুধু ভুল নয়, শাস্ত্রবিরুদ্ধও। বরং এই তিথি অন্য সব তিথির থেকেও মহাপবিত্র ও মহাপুণ্যময়। পিতৃপক্ষের সমাপ্ত অমাবস্যা যখন পূর্বপুরুষদের আশীর্বাদে ভরে ওঠে, তখনই তা হয়ে ওঠে “মহা-আলয়”—অর্থাৎ সমগ্র বিশ্ব আশীর্বাদে ধন্য মহালয়। তাই মহালয়া শুধু শুভ নয়, এটি এক মহাপুণ্যক্ষণ। তাই সংশয়ের অবসান ঘটিয়ে বলা যায়—মহালয়া কোনওভাবেই অশুভ নয়। বরং এটি পূর্বপুরুষদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করার দিন, আশীর্বাদ লাভের দিন। সুতরাং বাঙালি নিশ্চিন্তে বলতে পারে— “শুভ মহালয়া।”
Leave a Comment