Breaking News

Jamai Sasthi 2025: জল ছিটিয়ে পাখার বাতাস সঙ্গে হাতে হলুদ সুতোর নিয়ম! আর বাকি ষষ্ঠী কি আটকে জামাই-মেয়ের আদর আপ্যায়নে?

Image
 

ভাস্কর চক্রবর্তী, শিলিগুড়িঃ আজ জামাইষষ্ঠী। এই দিনটি নিছক ভোজ বা উপাচারের নয়, এ এক গভীর আন্তরিকতার উৎসব। এখানে শাশুড়ির স্নেহ যেন পরম মায়ায় জামাইয়ের হাসিকে আরও উজ্জ্বল করে তোলে, আর সেই হাসিই বুনে চলে সম্পর্কের এক অনবদ্য মাধুর্য। বাঙালির দিনপঞ্জিতে জামাইষষ্ঠী এক বিশেষ আবেগঘন স্থান অধিকার করে আছে। জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লা ষষ্ঠী তিথি এই পবিত্র সম্পর্কের উদযাপনকে আরও অর্থবহ করে তোলে। হিন্দু ক্যালেন্ডারের জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠ দিনে জামাই ষষ্ঠীর উৎসব পালিত হয়। জামাই ষষ্ঠীর উৎসব জামাই এবং শাশুড়ির মধ্যে সম্পর্ককে শক্তিশালী করার জন্য বিশেষ দিন। জামাই ষষ্ঠী পুনর্মিলন এবং সুখের দিন হিসেবে পালিত হয়। এই দিনে শাশুড়িরা দেবী ষষ্ঠীকে সন্তুষ্ট করার জন্য এবং তাদের মেয়ে জামাইদের সৌভাগ্য ও সমৃদ্ধির জন্য তাঁর আশীর্বাদ কামনা করার জন্য ষষ্ঠী পুজো করেন।

জামাই ষষ্ঠী উৎসব উদযাপনের পদ্ধতি: -

জামাই ষষ্ঠীর দিনে, শাশুড়িরা জামাই এবং মেয়েকে বাড়িতে আমন্ত্রণ জানান। জামাই ষষ্ঠীর দিনে, শাশুড়ি খুব ভোরে স্নান করে দেবী ষষ্ঠীর পুজো করেন এবং দেবীকে ফুল, দূর্বা এবং পাঁচ ধরণের ফল নিবেদন করা হয়। জামাইয়ের কপালে এক ফোঁটা দই দেওয়া হয় এবং তার কব্জিতে একটি হলুদ সুতো বাঁধা হয়। সুতোটি হলুদ দিয়ে হলুদ রাঙানো হয় এবং এটিকে ষষ্ঠী সুতো বলা হয়, যা মা ষষ্ঠীর আশীর্বাদ নিয়ে আসে। দেবী ষষ্ঠীর পুজোর পর, শাশুড়ি তার মেয়ে এবং জামাইয়ের দীর্ঘায়ু এবং মঙ্গল কামনা করে প্রার্থনা করেন এবং সকলের উপর পবিত্র গঙ্গা জল ছিটিয়ে দেন। এরপর শাশুড়ি একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান করেন যেখানে ছয়টি ফল সাজিয়ে সেই থালা জামাইয়ের কপালে ঠেকানো হয়। পুজো সম্পন্ন হওয়ার পর, শাশুড়ি জামাইকে প্রচুর ভালোবাসা ও স্নেহ দিয়ে যত্ন করে খাওয়ান এবং উপহারও দেন। 

জামাইষষ্ঠী পালনের প্রথা ও রীতিনীতি (জামাইষষ্ঠী পুজো পদ্ধতি ও বিধি): -

এক সময় বিয়ের পর মেয়েদের পিত্রালয়ে বারবার যাওয়া সমাজসিদ্ধ ছিল না। জামাইষষ্ঠী সেই সামাজিক ব্যবস্থার মধ্যেই এক ভালোবাসার সেতুবন্ধন গড়ে তোলে। জামাই ও কন্যাকে একত্রে আমন্ত্রণ জানিয়ে, শাশুড়ি-মা সাদর অভ্যর্থনার মাধ্যমে সম্পর্ককে মজবুত করেন। এই পুনর্মিলন শুধু একটি পারিবারিক ভোজ নয়, বরং আন্তরিকতার এক অনন্য বহিঃপ্রকাশ। দিনটি শুরু হয় ষষ্ঠী দেবীর পুজো দিয়ে, যেখানে ফলমূল, মিষ্টান্ন ও নানা উপচারে দেবীকে তুষ্ট করা হয়। জামাইয়ের আগমনে বাড়িতে শুরু হয় ধুমধাম—তাকে দেওয়া হয় তিলক, প্রদীপ আরতির মাধ্যমে শুভেচ্ছা ও আশীর্বাদ।

  • তিথি ও সময়: জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী তিথিতে এই উৎসব পালিত হয়। শাশুড়ি মায়েরা সাধারণত সকালে উপবাস করে ব্রত পালন করেন।
  • ষষ্ঠীদেবীর পুজোর প্রস্তুতি: সকালে শাশুড়ি মায়েরা স্নান করে শুদ্ধ বস্ত্র পরিধান করেন।  
  • উপকরণ: পুজোর জন্য জলপূর্ণ ঘট, আম পল্লব, তালপাতার পাখা, ১০৮টি দূর্বা (হলুদ মাখানো), ধান, ৫-৯ ধরণের গ্রীষ্মকালীন ফল (যেমন: আম, জাম, লিচু, কাঁঠাল), মিষ্টি, দই, পান-সুপারি, ফুল, বেলপাতা, সাদা সুতো, হলুদ, বাঁশের করুল, করমচা ফল ইত্যাদি উপকরণ জোগাড় করা হয়।  
  • পুজো স্থান: অনেক বাড়িতে ষষ্ঠী দেবীর ছবি বা প্রতীক (যেমন, পিটুলি দিয়ে কালো বেড়াল এঁকে) স্থাপন করা হয় এবং পাশে মঙ্গলঘট রাখা হয়।  
  • পুজো বিধি: শাশুড়ি মা দেবী ষষ্ঠীর মন্ত্র পাঠ করে কন্যা ও জামাইয়ের মঙ্গল কামনায় প্রার্থনা করেন।

জামাই বরণ ও আপ্যায়ন: -

প্রবাদে আছে, যম-জামাই ভাগনা-কেউ নয় আপনা। কারণ যম মানুষের মৃত্যু দূত। জামাই এবং ভাগনা অন্যের বাড়ির উত্তরাধিকারী। তাদের কখনও নিজের বলে দাবি করা যায় না। এদের খুশি করার জন্য মাঝে মাঝেই আদর আপ্যায়ন করে খাওয়াতে হয়। তাই মেয়ে যাতে সুখে-শান্তিতে তার দাম্পত্য জীবন কাটাতে পারে এজন্য জ্যৈষ্ঠ মাসে ( jamai sasthi 2025)  জামাইকে আদর করে বাড়িতে ডেকে এনে আম-দুধ খাইয়ে পরিতৃপ্ত করে। আশীর্বাদস্বরূপ উপহারসমাগ্রীও প্রদান করে । এই প্রথা উৎসবে পরিণত হয়েছে হিন্দু বাঙালিদের মধ্যে। জামাইষষ্ঠীর সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক নিঃসন্দেহে তার ভুরিভোজ। পাতে থাকে ইলিশ, চিংড়ি, পোলাও, মাংস, মাছের কালিয়া থেকে শুরু করে নানা ধরনের মিষ্টি। এসব আয়োজন যেন ভালোবাসার এক প্রতীক।

  • জামাই আগমন: জামাই ও কন্যা বাড়িতে আসার পর শাশুড়ি তাঁদের বরণ ডালা দিয়ে বরণ করেন। অনেক সময় শঙ্খ বাজিয়ে তাদের আগমনকে স্বাগত জানানো হয়।
  • আশীর্বাদ: শাশুড়ি জামাইয়ের হাতে হলুদ মাখানো সুতো বা ফুলের ডোরী বেঁধে দেন। এটি বন্ধন অটুট থাকার প্রতীক।
  • ফোঁটা ও আশীর্বাদ: জামাইয়ের কপালে দইয়ের ফোঁটা দেওয়া হয় এবং তালপাতার পাখা দিয়ে বাতাস করতে করতে "ষাট-ষাট-ষাট" বলে ধান-দূর্বা দিয়ে আশীর্বাদ করা হয়। "ষাট" বলার মাধ্যমে জামাইয়ের দীর্ঘায়ু কামনা করা হয়। ধান সমৃদ্ধি এবং দূর্বা সতেজতার প্রতীক।
  • জল ছিঁটানো: ষষ্ঠী দেবীর পুজোর জল জামাইয়ের গায়ে ছিটিয়ে দেওয়া হয়।

জামাইষষ্ঠী বা অরণ্য ষষ্ঠীর ব্রতকথা জানেন?

অরণ্য ষষ্ঠী, যা জামাইষষ্ঠী নামেও পরিচিত, মূলত মেয়ে-জামাইয়ের দাম্পত্য জীবনের সুখ ও দীর্ঘস্থায়ীত্ব এবং মেয়ের সুসন্তান লাভের আকাঙ্ক্ষায় শাশুড়িদের দ্বারা পালিত হয়। এই দিনটি বাংলার প্রতিটি ঘরে জামাই আপ্যায়নের এক বিশেষ উৎসবে পরিণত হয়। জামাইষষ্ঠীর ব্রত মাহাত্ম্য বর্ণনায় একটি প্রচলিত লোককথা রয়েছে: এক বাড়ির ছোট বউ ছিল ভীষণ লোভী। বাড়িতে সুস্বাদু কোনো খাবার এলেই সে গোপনে খেয়ে নিত আর শাশুড়ির কাছে বলতো, কালো বিড়ালে সব খেয়ে ফেলেছে। বিড়াল যেহেতু দেবী ষষ্ঠীর বাহন, তাই একদিন বিড়াল দেবী ষষ্ঠীর কাছে এই অভিযোগ জানালে তিনি অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হন। ফলস্বরূপ, ছোট বউয়ের প্রতিটি সন্তান জন্মের পরই দেবী তাদের প্রাণ হরণ করতে লাগলেন। এভাবেই ছোট বউ তার সাত পুত্র ও এক কন্যাকে হারায়। পরিবার ও সমাজের চোখে সে হয়ে ওঠে অলক্ষ্মী, যার ফলস্বরূপ স্বামী, শাশুড়ি ও অন্যান্যদের গালিগালাজ শুনে তাকে বাড়ি থেকে বিতাড়িত হতে হয়। অন্যদিকে, বড় বউ তার পুত্র-কন্যা নিয়ে সুখে জীবনযাপন করতে থাকে। দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে ছোট বউ বনে চলে গিয়ে একাকী কাঁদতে থাকে। তখন দেবী ষষ্ঠী এক বৃদ্ধার ছদ্মবেশে এসে তার কান্নার কারণ জানতে চান। নিজের সব দুঃখের কথা বলার পর দেবী তার পূর্বের অন্যায় আচরণের কথা স্মরণ করিয়ে দিলে ছোট বউ ক্ষমা প্রার্থনা করে। দেবী তাকে ক্ষমা করে দেন এবং বলেন যে, যদি সে ভক্তি সহকারে তাঁর পূজা করে, তবে তার হারানো সাত পুত্র ও এক কন্যাকে ফিরে পাবে। ছোট বউ সংসারে ফিরে এসে নিষ্ঠা সহকারে দেবী ষষ্ঠীর পূজা করে এবং একে একে তার সকল সন্তানকে ফিরে পায়। সেই দিন থেকেই জামাইষষ্ঠী বা অরণ্য ষষ্ঠীর এই ব্রত মাহাত্ম্য চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে।

বাঙালির ক্যালেন্ডারে জামাইষষ্ঠী একটি বিশেষ দিনঃ -

বলাবাহুল্য, জামাইষষ্ঠী—এটি কেবল একটি দিন নয়, এটি জামাইকে কেন্দ্র করে উদযাপিত এক অনন্য পার্বণ। মূলত পশ্চিমবঙ্গের ঘরে ঘরে পালিত এই উৎসবটি বাঙালি সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই দিনটিকে অত্যন্ত শুভ ও কল্যাণকর বলে মনে করা হয়, এবং এর মূল আকর্ষণ হলো পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এক বিশাল ভূরিভোজের আয়োজন। জামাইকে ঘিরে এই আয়োজন শুধু খাদ্যের নয়, বরং স্নেহ, সম্মান আর ভালোবাসার এক আন্তরিক বহিঃপ্রকাশ, যা পারিবারিক বন্ধনকে আরও সুদৃঢ় করে তোলে। এটি জামাইকে আপন করে নেওয়ার এক বিশেষ লৌকিক প্রথা, যা যুগ যুগ ধরে বাঙালি ঐতিহ্যে সযত্নে লালিত হয়ে আসছে।

Share With:


Leave a Comment

  

Other related news