দারিদ্র্যের দেয়াল ভেঙে স্বপ্নের আকাশে — শিলিগুড়ির মনোজিৎ দাসের লড়াই ও জয়ের গল্প
ভাস্কর চক্রবর্তী, শিলিগুড়ি: স্বপ্নের কোনো দাম নেই — কিন্তু সেই স্বপ্ন পূরণ করতে প্রায়শই প্রয়োজন হয় অর্থ, যা অনেকের জীবনে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। শিলিগুড়ির এক সাধারণ পরিবারে জন্ম নেওয়া মনোজিৎ দাসের জীবনেও সেই বাধা ছিল অটল পাহাড়ের মতো। কিন্তু মেধা, দৃঢ় সংকল্প ও সমাজের সহানুভূতির হাত ধরে সেই পাহাড় পেরিয়ে আজ সে দাঁড়িয়েছে এক নতুন দিগন্তের সামনে।
শিলিগুড়ি বরদাকান্ত বিদ্যালয়ের এই ছাত্র চলতি বছরের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় উজ্জ্বল ফলাফল করে সবার নজর কেড়ে নেয়। এরপর, উচ্চতর শিক্ষার স্বপ্ন পূরণে সে বসে জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষায়। দীর্ঘদিনের কঠোর অধ্যাবসায় ও অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলস্বরূপ সেই পরীক্ষায়ও সাফল্য অর্জন করে। সুযোগ আসে তেলেঙ্গানার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি (NIT), ওয়ারংগেলে পড়াশোনার। দেশের অন্যতম সেরা এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ার সুযোগ যেকোনো শিক্ষার্থীর কাছে গৌরবের — কিন্তু মনোজিতের সামনে তখনও এক বড় প্রশ্নচিহ্ন দাঁড়িয়ে: পড়াশোনার ব্যয়ভার কীভাবে বহন হবে?
পারিবারিক আয় ছিল সীমিত, যা দিয়ে সংসারের নিত্যপ্রয়োজন মেটানোই কঠিন। উচ্চশিক্ষার খরচ বহন করা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। এই দুঃসময়ে মনোজিৎ দ্বারস্থ হয় বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের কাছে। বিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে ২২ হাজার টাকার সহায়তা দেওয়া হয়। কিন্তু তবুও স্বপ্নপূরণের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পূর্ণ অর্থ জোগাড় হয়নি। এসময় বিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে বিষয়টি শিলিগুড়ি মিউনিসিপাল কর্পোরেশনের মেয়র গৌতম দেবের নজরে আনা হয়। খবর পেয়ে মেয়র ব্যক্তিগতভাবে মনোজিতের সঙ্গে দেখা করেন। তাঁর কথায়, “শিক্ষার পথ যেন কখনও অর্থের অভাবে থেমে না যায়। মেধা, পরিশ্রম আর স্বপ্নের প্রতি প্রতিশ্রুতিই একজনের ভবিষ্যৎ গড়ে দেয়, আর আমরা সেই যাত্রায় পাশে থাকতে চাই।” মেয়র দুই দফায় ব্যক্তিগতভাবে আর্থিক সহায়তা প্রদান করেন এবং আশ্বাস দেন যে ভবিষ্যতেও তিনি মনোজিতের পাশে থাকবেন।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বিপ্লব সরকার বলেন, “আমরা প্রথম থেকেই মনোজিতের পাশে ছিলাম। আমরা প্রত্যেক শিক্ষক-শিক্ষিকারা ব্যক্তিগত উদ্যোগেও ওকে সাহায্য করেছি। কিন্তু মেয়র মহাশয়ের এই উদারতা এবং মানবিক সহায়তা নিঃসন্দেহে সমাজের জন্য এক দৃষ্টান্ত। এটি শুধু মনোজিত নয়, বরং অসংখ্য মেধাবী কিন্তু আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীর জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।”
মনোজিতের গল্প আজ শিলিগুড়ি তথা গোটা রাজ্যের জন্য এক বার্তা বয়ে এনেছে — ইচ্ছাশক্তি, অধ্যবসায় আর সঠিক সহায়তা থাকলে দারিদ্র্যের শৃঙ্খলও ভেঙে যায়, আর স্বপ্ন পায় ডানা।
Leave a Comment