Breaking News

Phalaharini Amavasya 2025: সোমবতী না ফলহারিণী, জ্যৈষ্ঠ মাসের এই অমাবস্যায় অর্পিত পছন্দের ফল ১ বছর মুখে তোলা যাবে না, জানুন কেন

Image
 

ভাস্কর চক্রবর্তী, শিলিগুড়ি: জ্যৈষ্ঠ মাসের অমাবস্যায় পালিত হয় ফলহারিণী কালীপুজো। এই বিশেষ তিথি বাংলা জুড়ে প্রচলিত। চলতি বছরে জ্যৈষ্ঠ মাসের অমাবস্যা পড়েছে সোমবার। ফলে এই অমাবস্যা 'সোমবতী অমাবস্যা' নামেও পরিচিতি লাভ করেছে। এই পুজোয় দেবী কালীকে বিভিন্ন ধরনের ফল নিবেদন করে আরাধনা করা হয়। ভক্তরা বিশ্বাস করেন, এই দিনে দেবীর পুজো করলে মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয় এবং জীবনে সুখ-সমৃদ্ধি আসে। বিভিন্ন মন্দিরে এবং বাড়িতে এই পুজো উপলক্ষে বিশেষ আয়োজন করা হয়। আর সেই বিশ্বাস দেখা গেল শহর শিলিগুড়িতেও। শিলিগুড়ির বিভিন্ন কালীমন্দিরে এদিন দেখা দিল উপচে পড়া ভিড়। দর্শনার্থীদের ঢল ছিল চোখে পড়ার মতো। শহরের মহাবীরস্থানের আনন্দময়ী কালীবাড়ি, বা বিধান মার্কেট রোডের ভবানী কালীবাড়িতে বহু সকাল থেকেই দর্শনার্থীদের পুজো দিতে দেখা যায়‌। এনজেপি ভক্তিনগরের ত্রিশক্তি কালীমন্দিরেও একই চিত্র ধরা দিল। 

এদিন ত্রিশক্তি কালীমন্দিরের প্রধান পুরোহিত আশীষ চক্রবর্তী জানান, অমাবস্যার তিথি দুপুর ১২ টা ১৩ মিনিট থেকে। আর অবসান হবে ২৭ মে, ২০২৫ সালে। বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকামতে, সেদিন মঙ্গলবার সকাল ৮ টা ৩২ মিনিটে এই অমাবস্যার তিথি শেষ হচ্ছে। অন্যদিকে, গুপ্তপ্রেস পঞ্জিকামতে, ২০২৫ ফলহারিণী অমাবস্যা সোমবার ২৬ মে ২০২৫ সালে পড়ছে। সেদিন সকাল ১১ টা ৭ মিনিটে পড়ছে এই তিথি। অমাবস্যা তিথির অবসান, ২৭ মে মঙ্গলবার। সেদিন সকাল ৮ টা ৪৪ মিনিটে শেষ হবে তিথি। এদিন বিশেষ ফলাদি তথা মরশুমি ফল দিয়ে দেবীকে পুজো করা হয়। আম, জাম, লিচু, আঙুর, আপেল সব রকম মরসুমি ফল দিয়ে মালা তৈরি করে দেবীকে পরানোর রীতিও রয়েছে। এছাড়াও পঞ্চব্যঞ্জন, খিচুড়ি নবরত্ন তরকারি, পাঁচ রকমের ভাজা, চাটনি, দই ও মিষ্টি দিয়ে ভোগ দেওয়া হয়। এছাড়াও মায়ের সান্ধ্যকালিক আহারে তথা ভোগে পায়েশ, লুচি ও মিষ্টিও থাকছে। এমন দিনে মনষ্কামনা পূরণে কোনও ফল দিয়ে দেবীর পুজোয় অঞ্জলী দেওয়া হলে সেই ফল আগামী একবছর ভক্ষণ থেকে বিরত থাকার রীতিও রয়েছে।

২৬ মে পালিত হবে ফলহারিণী কালী পুজো। এই তিথিতে দেবী কালীর আরাধনা করলে সমস্ত পাপ কর্মের ফল থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। ফলহারিণী কালী পুজোর সময়, পুজোর নিয়ম ও মাহাত্ম্য জেনে নেওয়া যাক।

ফলহারিণী অমাবস্যার দিনক্ষণঃ

বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত ও গুপ্তপ্রেস পঞ্জিকা অনুযায়ী কবে ফলহারিণী অমাবস্যা তিথি পালিত হবে, তা এখানে জেনে নিন।

বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা

তিথি সময়
অমাবস্যা শুরু ২৬ মে ২০২৫ সোমবার দুপুর ১২টা ১৩ মিনিটে
অমাবস্যা শেষ ২৭ মে ২০২৫ মঙ্গলবার সকাল ৮টা ৩২ মিনিট

গুপ্তপ্রেস পঞ্জিকা

তিথি সময়
অমাবস্যা শুরু ২৬ মে ২০২৫ সোমবার সকাল ১১টা ৭ মিনিটে
অমাবস্যা শেষ ২৭ মে ২০২৫ মঙ্গলবার সকাল ৮টা ৪৪ মিনিটে
  উল্লেখ্য অমাবস্যা তিথিতে বিশেষত রাতের বেলা কালী পুজো করা হয়ে থাকে। এ কারণে ২৬ মে ফলহারিণী কালী পুজো করা হবে

ফলহারিণী কালী পূজার তাৎপর্য:

দীপাবলির জাঁকজমকপূর্ণ কালী পূজার থেকে ফলহারিণী কালী পূজা অনেক বেশি অন্তরঙ্গ ও আধ্যাত্মিকভাবে গভীর। 'ফলহারিণী' নামের অর্থ হল "কর্মফলের বিনাশকারিণী", যা ভক্তদের কর্মঋণ থেকে মুক্ত করার দেবীর ক্ষমতাকে বোঝায়। তন্ত্র সাধনায় এই পূজা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে কালীকে রূপান্তরের পরম শক্তি হিসেবে পূজা করা হয়। এই পূজার অন্যতম গভীর দিক হলো এর সঙ্গে মহান সাধক ও রহস্যময় শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসের সম্পর্ক। এই রাতে তিনি একটি বিশেষ আচার পালন করেছিলেন, যেখানে তিনি তাঁর স্ত্রী সারদা দেবীকে দেবী কালীর কাছে উৎসর্গ করেছিলেন। এটি আত্মার পরম চেতনার সাথে ঐশ্বরিক মিলনের প্রতীক।

ফলহারিণী কালী পূজার প্রণাম মন্ত্র:

|| নমঃ কালী কালী মহাকালী কালীকে পাপহারিণী || ধর্ম্মার্থ মোক্ষদে দেবী নারায়ণী নমোহস্তুতে || সর্বমঙ্গল মঙ্গল্যে শিবে সর্বার্থ সাধিকে || শরণ্যে ত্রম্বকেগৌরি নারায়ণী নমোহস্তুতে ||

ফলহারিণী কালী পুজোর নিয়ম:

শাস্ত্র মতে নিজের ভক্তের মনস্কামনা পূরণ করতে দেবী মর্ত্যে আসেন। এই তিথিতে মা কালীকে নানা মরশুমি ফল দিয়ে পুজো করা হয়। তারাপীঠ-সহ নানান কালী মন্দিরে এই তিথিতে দেবীকে ফুলের পরিবর্তে ফল দিয়ে সাজানো হয়। এ দিন দেবীকে নিজের প্রিয় ফল নিবেদন করে পুজো দেওয়া হয়। পুজোর পর সেই ফল বাড়িতে এনে রেখে দিতে হয়। নিয়ম অনুযায়ী এক বছর সেই ফল খাওয়া যায় না। যে মনস্কামনা করে ফল নিবেদন করেছিলেন, তা এক বছরের মধ্যে পূরণ হলে সেই ফলটি গঙ্গায় ভাসিয়ে দিতে হয়। এর পর কালীর পুজো করে পুনরায় সেই ফল খাওয়া শুরু করা যায়।

ফলহারিণী অমাবস্যা ও কালী পুজোর মাহাত্ম্য:

ফলহারিণী অর্থাৎ হল ফল হরণকারী। ফলহারিণী স্বরূপে মা কালী সকল অশুভ ফল হরণ করে থাকেন। প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী, এই তিথিতে কালীর আরাধনা করলে অশুভ কাজ বা পাপের ফল নাশ করে দেবী শুভ ফল প্রদান করেন। কথিত আছে, ফলহারিণী অমাবস্যায় দেবীর আরাধনা করলে ব্যক্তি ১০ পাপ থেকে মুক্তি পেতে পারে। শাস্ত্রে ১০ ধরনের পাপের উল্লেখ পাওয়া যায়। যা শারীরিক, মৌখিক ও মানসিক পাপের পর্যায়ভুক্ত। চুরি, হিংসা করা এবং ব্যভিচারকে শারীরিক পাপ বলা হয়। আবার বাণীর মাধ্যমে আমরা যে পাপ করে থাকি সেটি মৌখিক পাপ হিসেবে গণ্য। অন্য দিকে মনে মনে কোনও ব্যক্তির সম্পর্কে খারাপ ধারণা পোষণ, মিথ্যাচারে জড়ানো, সম্পত্তি আত্মসাৎ বা কোনও ভুল চিন্তাভাবনা পোষণ করেন যাঁরা, তাঁরা মানসিক পাপ করে থাকেন। জ্যৈষ্ঠ অমাবস্যা তিথিতে কালীর পুজো করে এই সমস্ত পাপ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। শুধু তাই নয়, কালীর কৃপায় অর্থ, প্রতিপত্তি, যশ লাভ করা যায়। পেশাগত জীবনেও উন্নতি হয়। এমনকি সাংসারিক সুখ-সমৃদ্ধিও বজায় থাকে।

ফলহারিণী অমাবস্যার তিথিতে বট সাবিত্রী পুজোর দুর্লভ শুভ যোগ:

বট সাবিত্রী ব্রত এবং পুজো প্রতি বছর জ্যৈষ্ঠ অমাবস্যা তিথিতে পালন করা হয়। এই পুজোটি বিবাহিত নারীদের জন্য সৌভাগ্য এবং সুখী দাম্পত্য জীবনের আশীর্বাদ নিয়ে আসে বলে বিশ্বাস করা হয়। এই দিনে স্ত্রীরা তাঁদের স্বামীর দীর্ঘ জীবন, সুস্বাস্থ্য এবং সুখ-সমৃদ্ধির জন্য উপবাস ও প্রার্থনা করেন। কথিত আছে, বট গাছ দৈব বৃক্ষ হিসেবেই চিহ্নিত করেন হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর এবং সাবিত্রী বট গাছেই থাকেন। প্রলয়ের শেষে শ্রীকৃষ্ণও এই বট গাছের পাতাতেই প্রকট হয়েছিলেন। তুলসিদাস এই বট গাছকেই তীর্থরাজের ক্ষেত্র বলেছিলেন। এই বৃক্ষ কেবলনাত্র পবিত্রই নয় দীর্ঘায়ুরও প্রতীক। দীর্ঘায়ু, শক্তি, ধার্মিক মাহাত্মের কথা মাথায় রেখে এই গাছকে পুজো করা হয়। বট বৃক্ষের নীচে সাবিত্রী, সত্যবান এবং যমরাজের মূর্তি স্থাপন করে পুজো করা হয়। বট বৃক্ষের গোড়ায় জল ঢেলে, ফুল-ধূপ এবং মিষ্টি দিয়ে পুজো করাই রীতি। সুতো নিয়ে বট গাছের চারপাশে পরিক্রমাও করা হয়। এরপর গাছের কাণ্ডের চারপাশে সুতোটি বেঁধে দেওয়া হয়। মোট ৭ বার গাছের পরিক্রমা করা হয়। এরপর হাতে ভেজা চানা নিয়ে সাবিত্রী সত্যবানের কথা পাঠন শুনতে হয়। ভেজা চানা, কিছু টাকা আর বস্ত্র নিয়ে শাশুড়ির হাতে তুলে দিয়ে আশীর্বাদ দেন মহিলারা। বট গাছের ফল খেয়েই উপোস ভাঙেন তাঁরা।

ফলহারিণী কালীপুজোর সঙ্গে জড়িত ইতিহাস:

আজ ১১ই জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ অমাবস্যা তিথিতে ফলহারিণী কালী পূজা। আজকে সোমবতী অমাবস্যা। ১৮৭২ সালের ৫ জুন এই ফলহারিণী কালী পূজার  দিনেই শ্রীরামকৃষ্ণ, শ্রীশ্রীমাকে ষোড়শী রূপে পূজা করেছিলেন। দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে ঠাকুরের বসবাসের ঘরে হয়েছিল পূজার আয়োজন। রাত নটার কিছু পরে শ্রীশ্রীমা তাঁর জন‍্য নির্দিষ্ট পূজার আসনে এসে বসলেন। এতো আর কোনো সাধারণ পূজা নয়! এ যে স্বয়ং ভগবান, ভগবতীর চরণে তাঁর সাধনার সমস্ত ফল অর্পণ করবেন -- তার‌ই আয়োজন। এ যে বিশ্বের আধ‍্যাত্মিক ইতিহাসের এক এবং অদ্বিতীয় ঘটনা হতে চলেছে। এর আগে কখনো কোনো অবতার, কোনো সিদ্ধপুরুষ তাঁর বিবাহিত স্ত্রীর চরণে এভাবে নিজের সমস্ত সাধনালব্ধ ফল সমর্পণ করেননি। আধ‍্যাত্মিক দৃষ্টিকে সরিয়ে রেখে সামাজিক দৃষ্টিতে দেখলে ,এই অভূতপূর্ব  ঘটনাকে মনে হয় , যুগ যুগ ধরে লাঞ্ছিতা ও বঞ্চিতা নারীকে সর্বোচ্চ সম্মান প্রদানের ঘটনা।

মন্ত্রপূত কলসীর জলে ঠাকুর বারবার শ্রীশ্রীমায়ের অভিষেক করলেন। মা তখন অর্ধবাহ‍্যদশায় নিমগ্না। ঠাকুর প্রার্থনামন্ত্র উচ্চারণ করলেন -

"হে বালে, হে সর্বশক্তির অধীশ্বরী মাতঃ ত্রিপুরসুন্দরী, সিদ্ধিদ্বার উন্মুক্ত কর; ইঁহার শরীর মনকে পবিত্র করিয়া ইঁহাতে আবির্ভূতা হ‌ইয়া সর্বকল‍্যাণ সাধন কর।"

পূজাশেষে ঠাকুর ভোগ নিবেদন করলেন। তিনি সামনে আসীন দেবী শ্রীশ্রীমায়ের  মুখে নিজের হাতে ভোগের থেকে কিছু মিষ্টি অর্পণ করলেন। দেখতে দেখতে অর্ধবাহ‍্যদশায় থাকা শ্রীশ্রীমা সমাধিস্থা হলেন। ঠাকুর‌ও মন্ত্রোচ্চারণ করতে করতে সমাধিরাজ‍্যে চলে গেলেন।

স্বামী গম্ভীরানন্দ লিখেছেন -

"সে ভূমিতে আত্মসংস্থ পূজক ও পূজিতা আত্মস্বরূপে পূর্ণভাবে একীভূত হ‌ইলেন।"

পূজার শেষে ঠাকুর নিজেকে, তাঁর জপের মালা প্রভৃতি এবং তাঁর সাধনার সমস্ত ফল দেবীর চরণে চিরকালের মত অর্পণ করলেন; তারপর মন্ত্রোচ্চারণ করতে করতে তাঁকে প্রণাম করলেন এবং বললেন -

"হে সর্বমঙ্গলের মঙ্গলস্বরূপ, হে সর্বকর্ম নিষ্পন্নকারিণী, হে শরণদায়িনী, ত্রিনয়নী, শিবগেহিনি গৌরি, হে নারায়ণি, তোমাকে প্রণাম করি।" 

পূজা শেষ হল। ঠাকুর শ্রীশ্রীমায়ের মধ‍্যে সুপ্ত দেবীত্বের পূর্ণ বিকাশ সাধন করলেন সেদিন। পূজা শেষে নহবতের ঘরে ফেরার সময় শ্রীশ্রী মায়ের মনে হল ঠাকুর তাঁকে প্রণাম করেছিলেন। সে প্রণাম তিনি ফিরিয়ে দেননি। তিনি ঠাকুরকে মনে মনে প্রণাম করলেন এবং নহবতে ফিরে এলেন। 

Share With:


Leave a Comment

  

Other related news