Breaking News

উপাচার্যের অভাবে অচলাবস্থা উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে! থমকে গবেষণা, আশঙ্কায় গবেষকদের ভবিষ্যৎ

Image
 

ভাস্কর চক্রবর্তী, শিলিগুড়ি: উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে (এনবিইউ) স্থায়ী উপাচার্যের অনুপস্থিতির কারণে গবেষণার কাজ এবং পিএইচ.ডি. সংক্রান্ত প্রক্রিয়া চরম অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে। বোর্ডের অফ রিসার্চ স্টাডিজ (BRS) বৈঠক দীর্ঘ সময় ধরে অনুষ্ঠিত না হওয়ায় পিএইচ.ডি. থিসিস জমা ও নতুন ভর্তির প্রক্রিয়া থমকে গিয়েছে। এর ফলে বহু গবেষকের ভবিষ্যৎ কর্মজীবন প্রভাবিত হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা শিক্ষার্থীরা। যদিও, গবেষকদের আবেদনের পর নবনিযুক্ত রেজিস্ট্রার দ্রুত পদক্ষেপের আশ্বাস দিয়েছেন।

গবেষকদের উদ্বেগ ও স্মারকলিপি:

বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা শিক্ষার্থীরা সম্মিলিতভাবে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে জানিয়েছেন যে, দীর্ঘদিন ধরে বিআরএস বৈঠক না হওয়ায় ইতিমধ্যে জমা পড়া পিএইচ.ডি. থিসিসগুলি বিশ্ববিদ্যালয়ে আটকে রয়েছে। ফলস্বরূপ, এই থিসিসগুলি বিশেষজ্ঞদের মূল্যায়নের জন্য পাঠানো যাচ্ছে না। গবেষকদের দাবি, দ্রুত এই সমস্যার সমাধান করা হোক, কারণ ডিগ্রি হাতে না থাকায় তারা কোনো পোস্ট-ডক্টরাল ফেলোশিপ বা চাকুরির জন্য আবেদন করতে পারছেন না। গবেষকদের মধ্য থেকে অয়ন মোহান্তি, বিবেকানন্দ রায়রা বলেন, “আমরা, উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা, পিএইচ.ডি. কোর্সওয়ার্কের ভর্তি প্রক্রিয়া দ্রুত শুরু করার অনুরোধ জানিয়ে সম্মানীয় রেজিস্ট্রার মহাশয়ের নিকট আজ একটি লিখিত আবেদনপত্র (ডেপুটেশন) প্রদান করেছি। আমাদের এই আবেদন মূলত গবেষণা-ইচ্ছুক ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে কোর্সওয়ার্ক শুরু হওয়া নিয়ে তৈরি হওয়া উদ্বেগ ও বিলম্বজনিত সমস্যার প্রেক্ষিতে করা হয়েছে, কারণ এই কোর্সওয়ার্কটি গবেষণার জন্য অপরিহার্য।”

উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃণমূল ছাত্র পরিষদের তরফে হরিপদ সিংহ বলেন, “আমরা, উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের (এনবিইউ) ছাত্রছাত্রীরা, পিএইচ.ডি. কোর্সওয়ার্কের ভর্তি প্রক্রিয়া দ্রুত শুরু করার অনুরোধ জানিয়ে সম্মানীয় রেজিস্ট্রার মহাশয়ের নিকট আজ একটি লিখিত আবেদনপত্র (ডেপুটেশন) প্রদান করেছি তারিখে। রেজিস্ট্রার মহাশয় আমাদের আবেদনকে গুরুত্বসহকারে গ্রহণ করেছেন এবং পিএইচ.ডি. কোর্সওয়ার্ক ভর্তি প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। তাঁর এই তৎপরতা ও ইতিবাচক পদক্ষেপ আমাদের সকলের জন্য আশার আলো। এই উদ্যোগ গ্রহণের জন্য আমরা রেজিস্ট্রার মহাশয়ের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। আমরা তাঁকে ধন্যবাদ জানাই এবং আশা করি ভর্তি প্রক্রিয়াটি যথাসময়ে ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হবে।” এছাড়াও, বিআরএস বৈঠক না হওয়ায় বিভিন্ন বিভাগের বহু গবেষক তাদের থিসিস টাইটেল রেজিস্ট্রেশন করাতে পারছেন না। রেজিস্ট্রেশন না হওয়া এবং জুনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ (JRF) থেকে সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ (SRF)-এ আপগ্রেডেশন না হওয়ায়, অনেক অর্থায়ন সংস্থা গবেষকদের কষ্টার্জিত ফেলোশিপ বন্ধ করে দেবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এটিকে একটি গুরুতর সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করে গবেষকরা দ্রুত সমাধানের দাবি জানিয়েছেন।

গবেষকদের আরও অভিযোগ, বর্তমান শিক্ষাবর্ষের জন্য নতুন পিএইচ.ডি. ভর্তির কোনো বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়নি। ফলস্বরূপ, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের অধীনে ইতিমধ্যে বহু শিক্ষার্থী বিভিন্ন সুপারভাইজারের তত্ত্বাবধানে কাজ শুরু করলেও, যথাযথ ভর্তি এবং কোর্সওয়ার্ক সম্পন্ন না হওয়ায় তারা তাদের ফেলোশিপ পেতে সমস্যায় পড়ছেন। এর কারণে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীকে তাদের গবেষণা কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যেতে বাধ্য হতে হচ্ছে। গবেষকরা কর্তৃপক্ষকে এই বিষয়টি খতিয়ে দেখতে এবং অন্তত যে বিভাগগুলিতে সম্ভব, সেগুলির জন্য পিএইচ.ডি. ভর্তি প্রক্রিয়া সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি দ্রুত প্রকাশের অনুরোধ করেছেন।

রেজিস্ট্রারের আশ্বাসে স্বস্তি:

আবেদন জমা দেওয়ার পর গবেষকরা আনন্দের সঙ্গে জানিয়েছেন যে, নবনিযুক্ত রেজিস্ট্রার মহাশয় তাদের আবেদনকে গুরুত্বসহকারে গ্রহণ করেছেন। অয়ন মোহান্তি ও হরিপদ সিংহ বলেন, "আমরা আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি যে রেজিস্ট্রার মহাশয় আমাদের আবেদনকে গুরুত্বসহকারে গ্রহণ করেছেন এবং পিএইচ.ডি. কোর্সওয়ার্ক ভর্তি প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। তাঁর এই তৎপরতা ও ইতিবাচক পদক্ষেপ আমাদের সকলের জন্য আশার আলো।" তাঁরা রেজিস্ট্রারকে ধন্যবাদ জানিয়ে আশা প্রকাশ করেছেন যে ভর্তি প্রক্রিয়াটি যথাসময়ে ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হবে।

অস্থায়ী উপাচার্যের অভাবই মূল কারণ: রেজিস্ট্রার


গবেষকদের অভিযোগ এক কথায় মেনে নেন উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের নবনিযুক্ত নিবন্ধক (Registrar) প্রফেসর ডঃ ভাস্কর বিশ্বাস। তিনি আমাদের বলেন, "এ কথা অস্বীকার করার কোনো জায়গা নেই যে আমাদের উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিগত দু'বছর থেকে নতুন করে গবেষণায় ভর্তি নেই। কারণ একটাই, অস্থায়ী উপাচার্য। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন পর্যন্ত স্থায়ী উপাচার্যের যে অভাব তা এক্কেবারেই স্পষ্ট। ২০২৪ সালের ১৯ এপ্রিল থেকে এখন পর্যন্ত স্থায়ী উপাচার্য আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় পায়নি। আর এর ফলে সততই; থিসিসের কাজ, নানান গবেষণামূলক পত্র সহ বিভিন্ন গবেষণার কাজে বিশ্ববিদ্যালয় পিছিয়ে যাচ্ছে।"

ভাস্করবাবু আরও বলেন, "এটা তো সত্যি যে উপাচার্যের ভূমিকা একটি বিশ্ববিদ্যালয় অপরিসীম। কিন্তু তাই বলে আর তাঁর অনুপস্থিতি, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিত্য কাজে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। আর আমাদের একটি দায়িত্ব বৃদ্ধি পায়। একজন শিক্ষক হিসেবে নৈতিক দায়বদ্ধতা এসে যায়। কিভাবে একটি শিক্ষক হয়ে, ছাত্র-ছাত্রীদের ভবিষ্যৎকে একটি অন্ধকারে আমরা ঠেলে দিতে পারি? দিনের পর দিন এই অচলাবস্থা ছাত্র-ছাত্রীদের, গবেষকদের জীবন থেকে সময়ের পর সময় কেড়ে নিচ্ছে। একটি উঠতি গবেষকের জীবনে এক মাস, দু'মাস বা ছয় মাস যখন চলে যায়, সেই সময়টা কতটা গুরুত্বপূর্ণ, একজন শিক্ষক হিসেবে আমি উপলব্ধি করতে পেরেছি।"

তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেন, "২০২৩ সালের জুন মাসে যাঁরা জিআরএফ (JRF) হয়ে এসেছিলেন, তাঁদের বেশিরভাগই এখনও পর্যন্ত কোনো অ্যাডমিশন বা ভর্তি ছাড়াই গবেষণার কাজ চালিয়ে গিয়েছে। এবার দু'বছর পর, ইউজিসির (UGC) নিয়মানুযায়ী, প্রত্যেকজন জিআরএফকে (JRF) এসআরএফে (SRF) পদোন্নতি দিতে হয়। কিন্তু, এই নিয়মে বাধা হয়েছে সেই অচলাবস্থা। কারণ, পিএইচডির (PhD) ভর্তি নিয়ে কোর্স ওয়ার্ক সম্পন্ন করলেই রেজিস্ট্রেশন করানো সম্ভব। আর তারপরই জিআরএফদের (JRF) পদোন্নতি দেওয়া যায়। কিন্তু এই মুহূর্তে সেই কাজটাও আমরা করতে অপারগ। আর এতে গবেষকদের বিশাল অংশ মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে।"

আর্থিক সংকটেও গবেষকরা:


ভাস্করবাবুর কথায়, "উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় একটি প্রান্তিক বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে বিভিন্ন স্তরের ছাত্র-ছাত্রীরা যেমন পড়তে আসে তেমনি বিভিন্ন স্তরের গবেষকরাও গবেষণা করতে আসেন। সেখানে জেআরএফের (JRF) যে সংখ্যক ছেলেমেয়ে আসেন, তাদের অধিকাংশই ফেলোশিপের অর্থমূল্য বাড়িতে দিয়ে সাহায্য করে থাকেন। আর কোর্স ওয়ার্ক চালু না করলে সেই ফেলোশিপের অর্থসাহায্য চালু হচ্ছে না। ফলত গবেষকদের বড় অংশ আর্থিকভাবে যেমন ধুঁকছে, তেমনই তাঁদের কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ারও একটা আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।" এই গুরুতর পরিস্থিতি উপলব্ধি করেই রেজিস্ট্রার প্রফেসর ডঃ ভাস্কর বিশ্বাস বলেন, "ঠিক এই কারণেই আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিনের সঙ্গে কথা বলেছি। এছাড়াও যত আধিকারিক রয়েছেন তাঁদের সঙ্গেও কথা হয়েছে। ফলে আমি BRS ডাকতে আমি একপ্রকার বাধ্য হয়েছি।"

শিক্ষকমহলের উদ্বেগ:


বিশ্ববিদ্যালয়ে নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক সিনিয়র প্রোফেসর বলেন, "বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার কাজ একেবারেই ভেঙে পড়েছে। আর এর জন্য কিছুটা হলেও আমরা শিক্ষকরা যেমন দায়ী, তার থেকেও সব থেকে বড় কারণ উপাচার্য পদ খালি থাকা। ইতিমধ্যে আমরা বহু মেধাবী ছাত্র-ছাত্রী, যারা বিভিন্নভাবে স্নাতকোত্তর স্তরে শীর্ষস্থান অধিকার করে, তাঁরা পিএইচডি ইন্সপায়ারের (PhD - Inspire) জন্য সততই যোগ্য হয়ে যায়। কিন্তু দুঃখের বিষয়ে এই যে, বিগত কয়েক বছর ধরে শীর্ষস্থানাধিকারী পেলেও তাঁদেরকে পিএইচডি ইন্সপায়ারের (PhD - Inspire) জন্য মনোনীত করতে ব্যর্থ হয়েছে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়। যা শিক্ষক হিসেবে একপ্রকার লজ্জার।" তিনি আরও বলেন, "বহু শিক্ষক, এই কাজ করার জন্য বাধা প্রদান করছেন, যা আরও লজ্জার। আমার অনুরোধ, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ ফিরিয়ে আনতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার কাজ আবার পুনঃ চালু করতে হবে। তা না হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে অশনি সংকেত দেখতে পাচ্ছি।" 

Share With:


Leave a Comment

  

Other related news