ফেলে দেওয়া ফুল থেকে নতুন স্বপ্ন, ধূপকাঠি উৎপাদনে বদলে যাচ্ছে গ্রামীণ অর্থনীতি
ভাস্কর চক্রবর্তী, শিলিগুড়ি
পরিবেশ রক্ষা ও অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার বিরল সমন্বয় ঘটল উত্তরবঙ্গের চা-বাগান এলাকা জুড়ে। পুজো বা বিভিন্ন ধর্মীয় আয়োজন শেষে যেসব ফুল নদী বা নর্দমায় ফেলে দেওয়া হয় — ঠিক সেই ‘অপচয়’ হওয়া ফুলকেই কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করে প্রাকৃতিক ধূপকাঠি তৈরি করছেন চা-বাগানের অসংখ্য মহিলা। ফেলে দেওয়া ফুল সংগ্রহ করে তা পুনর্ব্যবহারযোগ্য উপায়ে ধূপকাঠি তৈরির এই উদ্যোগ গ্রামীণ অর্থনীতিতে নতুন দিশা এনে দিয়েছে। এই কর্ম যজ্ঞে ব্রতী হয়েছে শিলিগুড়ির লিভ-লাইফ হ্যাপিলি (Live Life Happily) সমাজসেবী তথা অধ্যাপক ডঃ অনির্বাণ নন্দী (Dr. Anirban Nandy) ও পৌলমি চাকী নন্দী (Poulomi Chaki Nandy)। তাঁদের কথায়, “আমাদের উৎপাদন প্রক্রিয়ায় যে ফুলগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে, সেগুলো মূলত দুর্গাপূজার পর বিভিন্ন মণ্ডপ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। আবার অনেকেই বিষয়টি জানার পর স্বেচ্ছায় তাদের বাড়ি থেকেও ফুল দিয়েছেন। সাধারণত এসব ফুল আমরা নদীতে বা ফেলে দিই, যার ফলে নদীর জৈবিক সমতা নষ্ট হয় এবং নদীদূষণ বাড়ে। এই সমস্যা রোধ করার লক্ষ্যেই আমরা এই পরিত্যক্ত ফুলগুলোকে সম্পদে পরিণত করে ধূপ (Incense) তৈরির উদ্যোগ নিয়েছি।”
উৎপাদন প্রক্রিয়া
- ফুল সংগ্রহ - বিভিন্ন মণ্ডপ ও বাসাবাড়ি থেকে সংগৃহীত ফুল প্রথমে আলাদা করা হয়।
- সোলার ড্রাই (সূর্যের তাপে শুকানো) - ফুলগুলো প্রাকৃতিকভাবে শুকিয়ে নেওয়া হয় যাতে আর্দ্রতা দূর হয়।
- ক্রাশিং (গুঁড়ো করা) - শুকনো ফুল, বেলপাতা ও শিউলি (বা অনুরূপ পাতা) একসঙ্গে ক্রাশ করে পাউডার তৈরি করা হচ্ছে।
- মিক্সিং (গ্রামে চলছে বর্তমান কাজ) - পাউডারের সঙ্গে গোবর, এসেন্স (যেমন জেসমিন, ভ্যানিলা), এবং ধূপ তৈরিতে প্রয়োজনীয় অন্যান্য প্রাকৃতিক উপাদান মেশানো হয়।
- শুকানো - মিক্সিং শেষে আবার রোদে শুকানো হয় যেন মিশ্রণে কোনো আর্দ্রতা না থাকে।
- শেপিং (ধূপ তৈরি) - সাধারণ কাঠির ধূপ না বানিয়ে আমরা গোলাকার বা অন্য নান্দনিক আকারে ধূপ তৈরি করছি এবং প্রতিটি ধূপে একটি স্ট্যাম্প ব্যবহার করা হবে যাতে সেটি আলাদা করে চেনা যায়।
- প্যাকেটিং - শুকানোর পর ২০০ গ্রাম ওজনের প্যাকেটে বাজারজাত করা হবে।
পরিবেশ ও সমাজের উপকার
- নদীদূষণ রোধ – নদীতে ফুল ফেলা বন্ধ করা সম্ভব হবে।
- বর্জ্য থেকে সম্পদ – ফেলে দেওয়া ফুল থেকেই তৈরি হচ্ছে অর্থনৈতিক পণ্য।
- নারী ও ছাত্রছাত্রীদের কর্মসংস্থান – কলেজ স্তরের ছাত্রীরা এই প্রকল্পে কাজ করে মেকিং চার্জ ও লাভের অংশীদার হবে। এতে অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন হবে।
- গ্রামীণ উন্নয়ন – গ্রামে উৎপাদন হওয়ায় স্থানীয় মানুষ কাজের সুযোগ পাচ্ছে।
বাজারজাতকরণ পরিকল্পনা
আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে উৎপাদন শেষ করে বাজারে ছাড়ার পরিকল্পনা রয়েছে। প্রথমে করিবাড়ি নকশালবাড়ি, আপার বাগডোগরা ও বাগডোগরা চত্বর এলাকায় বিক্রি শুরু হবে। বাগডোগরা হাটেও বিক্রির পরিকল্পনা আছে। সাড়া পেলে আমরা স্থায়ীভাবে ফুল সংগ্রহের জন্য শহরের মাঝে সংগ্রহ কেন্দ্র (Collection Point) চালু করব, যেখানে মানুষ বাড়ির পূজার ফুল জমা দিতে পারবে।
ওজন বিষয়ক তথ্য
- সংগ্রহের সময় ফুলের ওজন → ৪০–৫০ কেজি
- শুকানোর পরে ওজন কমে যায় (আর্দ্রতা চলে যাওয়ায়)
- মিক্সিং শেষে চূড়ান্ত ওজন বাড়বে
- ফাইনাল ওজন প্যাকেটিং শেষে নির্ধারিত হবে (প্রতি প্যাকেট ২০০ গ্রাম করে বিক্রি হবে)
অপচয় থেকে উদ্যোগ, উদ্যোগ থেকে রোজগার
শিলিগুড়ি সংলগ্ন মাটিগাড়া, নকশালবাড়ি, ময়নাগুড়ি, বাগডোগরা, ফাঁসিদেওয়া, ডাবগ্রামসহ ডুয়ার্সের একাধিক চা-বাগান এলাকায় শুরু হয়েছে এই কাজ। আগে পূজোশেষে ফুল নদীতে ফেলা হত বা আবর্জনার স্তূপে জমে দুর্গন্ধ ছড়াত। এখন স্থানীয় মহিলা দল ফুল সংগ্রহ করে তা শুকিয়ে পিষে তৈরি করছেন ধূপকাঠি, যা বাজারে বিক্রিও হচ্ছে দারুণভাবে। চা-বাগানের শ্রমিক মেরিনা এক্কা বলেন, "আগে চা-বাগানের সামান্য মজুরিই ছিল আয়। এখন বাড়িতে বসে ফুল দিয়ে ধূপকাঠি বানিয়ে প্রতি মাসে অতিরিক্ত আয়ের সুযোগ পাচ্ছি। এতে সংসারে স্বচ্ছলতা এসেছে।"
কীভাবে তৈরি হয় এই প্রাকৃতিক ধূপকাঠি?
পুরো প্রক্রিয়াটি সহজ হলেও নিয়ম মেনে ও পরিচ্ছন্নভাবে করা জরুরি। তৈরির ধাপগুলো —
- মণ্ডপ, মন্দির বা ঘরোয়া পুজো থেকে ফুল সংগ্রহ
- পাপড়ি আলাদা করে রোদে শুকানো
- শুকনো পাপড়ি পিষে গুঁড়ো তৈরি
- কাঠের গুঁড়ো বা কয়লার গুঁড়োর সঙ্গে মেশানো
- বাঁশের কাঠিতে পেস্ট লাগিয়ে শুকানো
- প্রাকৃতিক সুগন্ধি (চন্দন, ল্যাভেন্ডার, গো-মূত্র, তুলসী ইত্যাদি) যোগ
- প্যাকেটজাত করে বাজারজাতকরণ
পরিবেশবান্ধব এই পদ্ধতিতে কোনও কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয় না, ফলে পণ্যের চাহিদা দ্রুত বাড়ছে।
স্বনির্ভর হচ্ছেন চা-বাগানের নারীশক্তি
এই উদ্যোগে সবচেয়ে বেশি লাভবান হচ্ছেন চা-বাগানের পরিশ্রমী মহিলারা।
- প্রতিটি গ্রামে ১০–১৫ জন করে মহিলা সেলফ-হেল্প গ্রুপ তৈরি হয়েছে
- বাড়ির কাজের ফাঁকে কাজ করার সুযোগ
- প্রতিদিন ২–৩ ঘণ্টা কাজ করেই মাসে ৩৫০০–৫০০০ টাকা আয়
- নিজের হাতে উপার্জনের ফলে নারীর সামাজিক অবস্থানও বেড়েছে
মহিলা উদ্যোক্তা বাসন্তী রায় বলেন, “গতকাল পর্যন্ত আমরা ভাবতাম এই ফুলের আর কোনও দাম নেই। আজ সেই ফুলই আমাদের আত্মসম্মান ও রোজগারের উৎস।”
উদ্যোগের পেছনে সহায়তা কারা দিল?
শিলিগুড়ি ও ডুয়ার্স অঞ্চলের কয়েকজন সমাজকর্মী ও উদ্যোক্তা প্রথমে এই প্রক্রিয়া নিয়ে গবেষণা করেন এবং পরে মহিলাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজ শুরু করেন। স্থানীয় পঞ্চায়েত ও স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মাধ্যমে ফুল সংগ্রহ ও উৎপাদনের ব্যবস্থা তৈরি হয়। প্রকল্প সমন্বয়কারী সৌম্য বিশ্বাস জানান, ফুল সংগ্রহ থেকে পণ্য বাজারে পৌঁছানো। পুরো চক্রে অন্তত ১০০ পরিবার যুক্ত হচ্ছে। ভবিষ্যতে এই কাজ আরও বড় পরিসরে নেওয়ার পরিকল্পনা চলছে।
শুধু ব্যবসা নয়, পরিবেশও বাঁচাচ্ছে এই উদ্যোগ
- প্রতিদিন টন টন ফুল নদীতে ফেলা বন্ধ হচ্ছে
- জল দূষণ কমছে
- মন্দির ও পুজো কমিটির আবর্জনা ব্যবস্থাপনা সহজ হচ্ছে
- গ্রামে সুরভিত পরিবেশ তৈরি হচ্ছে
চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে কয়েকটি
সবটা ভালো খবর নয় — কিছু সমস্যা এখনও প্রকট:
- বাজার সম্প্রসারণ ও বড় অর্ডারের অভাব
- ব্র্যান্ডিং ও সুন্দর প্যাকেজিংয়ের সমস্যা
- সরকারের আর্থিক সহায়তা নেই
- নিয়মিত কাঁচামাল সংগ্রহে সমস্যা হয়
তবে উদ্যোক্তারা আশাবাদী, সরকারি সহায়তা ও প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ পেলে এই প্রকল্প গ্রামীণ শিল্পে বিপ্লব ঘটাতে পারে।
সামনে কী পরিকল্পনা?
এই উদ্যোগ এখন সীমিত বাজারেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু পরিকল্পনা আরও বড়:
- অনলাইন বিক্রি শুরু হবে
- পশ্চিমবঙ্গ সরকার ও KVIC-এর সহায়তায় কারখানা স্থাপন
- রপ্তানিযোগ্য সুগন্ধি পণ্য বানানোর পরিকল্পনা
- ধূপকাঠি ছাড়াও ফুলের সাবান, ধূপকোণ, রুম ফ্রেশনার তৈরির প্রস্তুতি চলছে
চা-বাগানের এই উদ্যোগ প্রমাণ করেছে, স্বনির্ভরতা মানে শুধু বড় কারখানা বা বড় পুঁজি নয়। মানুষের ইচ্ছাশক্তি, মনের উদ্যোগ আর সামান্য প্রশিক্ষণেই বদলে দিতে পারে একটা সমাজের অর্থনৈতিক ও সামাজিক চিত্র। ফুল ফেলা নয়, এবার ফুলেই জীবিকা।
Leave a Comment