লাল সোনার রং এখন পাহাড়ি হাওয়ায়, জাফরানের নতুন জন্মভূমি উত্তরবঙ্গ
ভাস্কর চক্রবর্তী, শিলিগুড়ি
উত্তরবঙ্গের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিতে যুক্ত হলো নতুন সম্ভাবনার দিগন্ত। দীর্ঘ গবেষণা, নিরলস পরিশ্রম এবং বারবার পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর অবশেষে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় (University of North Bengal) পরীক্ষাগারে সফলভাবে জাফরান বা কেশর চাষে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। কাশ্মীর ছাড়া জাফরান চাষের ধারণা এতদিন অবাস্তব বলে মনে হলেও, এই গবেষণা সেই ধারণাকে ভুল প্রমাণ করেছে। গবেষকদের দাবি, এই বৈপ্লবিক আবিষ্কার শুধু একাডেমিক জগতেই নয়, উত্তরবঙ্গের পাহাড়ি ও পার্বত্য অঞ্চলের কৃষি অর্থনীতিতে বড় পরিবর্তন আনতে সক্ষম।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ Centre for Floriculture and Agri-Business Management (COFAM) ২০২৩ সালে এই প্রকল্প শুরু করে পরীক্ষামূলকভাবে। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কাশ্মীর থেকে আনা হয় ৮০ থেকে ১০০টি জাফরান কন্দ। শুরুতে প্রচলিত মাটিভিত্তিক চাষে কাঙ্ক্ষিত ফল মিলেনি। বহু ব্যর্থতার পর গবেষকরা ব্যবহার করেন আধুনিক বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি এরোপনিক ফার্মিং (Aeroponic Farming)। এই পদ্ধতিতে মাটি ছাড়াই কন্দকে বাতাসে ঝুলিয়ে রেখে শিকড়ে পুষ্টি-সমৃদ্ধ দ্রবণ স্প্রে করা হয়। এই আধুনিক প্রযুক্তিই বদলে দেয় ফলাফল—দীপাবলি উৎসবের আগেই পরীক্ষাগারে ফুটে ওঠে প্রথম বেগুনি জাফরান ফুল।
গবেষণা দলের সদস্যরা জানান, এটি ছিল তাঁদের দীর্ঘ অধ্যবসায়, ধৈর্য এবং প্রযুক্তিগত দক্ষতার ফসল। ব্যর্থতার পথ পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত এই সাফল্য তাঁদের কাছে আবেগেরও এক বিশেষ মুহূর্ত।
এই গবেষণা প্রকল্পের অন্যতম প্রধান বিজ্ঞানী ড. অমরেন্দ্র পাণ্ডে বলেন, “প্রথমদিকে বারবার ব্যর্থতার মুখে পড়তে হলেও আমরা হাল ছাড়িনি। বহু চেষ্টার পর এরোপনিক পদ্ধতিতে সাফল্য আসে। এই সাফল্য শুধু গবেষণা প্রকল্প নয় — উত্তরবঙ্গের কৃষকদের জন্য ভবিষ্যতের সম্ভাবনা। জাফরান চাষ কাশ্মীরের আবহাওয়ার উপর নির্ভরশীল বলে মনে করা হতো। কিন্তু এবার প্রমাণ হয়েছে — সঠিক প্রযুক্তি ব্যবহার করলে উত্তরবঙ্গেও জাফরানের উৎপাদন সম্ভব।”
তিনি আরও জানান, আগামী দিনে এই উদ্যোগকে মাঠ পর্যায়ে নিয়ে যেতে দার্জিলিং, কার্শিয়াং ও কালিম্পংয়ে প্রাথমিক পর্যায়ের চাষ শুরু হয়েছে। খুব শিগগিরই বাজারে আসতে পারে ‘দার্জিলিং স্যাফরন’ নামে আঞ্চলিক ব্র্যান্ড। তার আগে কাশ্মীরি জাফরানের সঙ্গে সুবাস, রঙ ও গুণমানের তুলনামূলক পরীক্ষা করা হবে। আগামী বছরের মধ্যেই নর্থ বেঙ্গল ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে ক্ষুদ্র জাফরান পার্ক তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে। পাশাপাশি স্থানীয় যুবকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে জাফরান ফার্মিং মডেল গড়ে তোলা হবে।
জাফরানের বিশেষত্ব ও সম্ভাবনা
- জাফরানকে বিশ্ব বাজারে বলা হয় ‘লাল সোনা’। কারণ—
- প্রতি গ্রাম জাফরানের দাম ৪০০ থেকে ১০০০ টাকা
- ওষুধ, প্রসাধনী, সুগন্ধি ও খাদ্য শিল্পে এর ব্যাপক ব্যবহার
- এরোপনিক চাষে জল খরচ কম এবং সারা বছর উৎপাদন সম্ভব
- মাটিবাহিত রোগের সম্ভাবনা নেই ও যত্নও তুলনামূলক কম
কৃষি বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, জাফরানের এই সাফল্য উত্তরবঙ্গের অর্থনীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারে। পাহাড়ি এলাকায় উচ্চমূল্যের ফসল হিসেবে জাফরান কৃষকদের আয় বহুগুণে বাড়াতে সক্ষম হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এরোপনিক ফার্মিং (Aeroponic Farming) পদ্ধতির সুবিধা
- খুব কম জল ব্যবহার
- মাটিবাহিত রোগমুক্ত
- সারা বছর উৎপাদনের সম্ভাবনা
- কম জায়গায় বেশি চাষ
- পরিবেশবান্ধব ও বৈজ্ঞানিক
কৃষকদের জন্য নতুন আয়ের পথ
কৃষি অর্থনীতিবিদদের দাবি, এই প্রকল্প সফল হলে উত্তরবঙ্গের পাহাড়ি অঞ্চলে বেকারত্ব কমবে, গড়ে উঠবে নতুন কৃষি-উদ্যোক্তা সম্প্রদায়। তরুণ প্রজন্মের কাছে এটি হতে পারে কৃষি-স্টার্টআপ বিপ্লবের সূচনা।
চ্যালেঞ্জ যা রয়ে গেল
তবে গবেষকরা জানিয়েছেন, এখনও বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ কাটিয়ে উঠতে হবে—
- আবহাওয়া পরিবর্তনের প্রভাব
- বাল্বের ধারাবাহিক সরবরাহ
- বাণিজ্যিক স্কেলিং-এর খরচ
- মান নিয়ন্ত্রণ ও বাজার প্রতিযোগিতা
- সরকারি সহায়তার দাবি - যদিও এই প্রকল্পকে অগ্রাধিকার দিয়ে এগিয়ে নিতে কেন্দ্র ও রাজ্যের কৃষি মন্ত্রকের সহযোগিতা প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বলাবাহুল্য, উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের এই উল্লেখযোগ্য গবেষণা সাফল্য শুধু একাডেমিক গৌরব নয়; এটি প্রমাণ করল — উন্নত প্রযুক্তির প্রয়োগে কৃষিজ সম্ভাবনা প্রসারিত করা সম্ভব। সামনের দিনগুলোয় যদি সঠিক দিকনির্দেশ ও সরকারি সহায়তা নিশ্চিত হয়, তবে জাফরান শুধু কাশ্মীর নয় — উত্তরবঙ্গের অর্থনৈতিক গর্ব হিসেবেও পরিচিত হতে পারে।
Leave a Comment